নামাযে কুরআন মাজীদ দেখে পড়ার বিধান
নামাযে কুরআন মাজীদ দেখে পড়ার বিধান
নামাযের ভিতর মোবাইল থেকে কুর'আন শরীফ দেখে পড়ার বিধান বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস'আলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। বহমান এই সময়ে সর্বক্ষেত্রে মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সেই ধারায় মোবাইলে কুর'আন পড়ার বিষয়টাও রয়েছে। নামাযের বাইরে পড়া তো আমাদের দেশেই ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে উঠেছে। তবে আরব ভূখণ্ডসহ বিভিন্ন দেশে নামাজের মধ্যেও মোবাইল দেখে কিরাত পড়ার প্রচলন রয়েছে। সেই দেখাদেখি আমাদের দেশের কিছু ভাই নামাযের কিরাত মোবাইলে দেখে দেখে পড়েন। তো আসুন জেনে নেওয়া যাক নামাযের ভিতর মোবাইলে দেখে কিরাত পড়ার বিধান কী?একথা তো স্পষ্ট যে, মোবাইলের মাস'আলা জাদীদ মাস'আলা এর অন্তর্ভুক্ত। নামাযের মধ্যে মোবাইলে দেখে দেখে কুর'আন পড়াকে ক্বিয়াস করা হয় মাসহাফ দেখে পড়ার মাস'আলার সাথে। আর নামাযে মাসহাফ দেখে পড়ার মাসয়ালাটি ইখতেলাফী মাসয়ালা। এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামের কিছু ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। তার বর্ণনা নিম্নরূপঃ-
(১) ইমাম আযম আবু হানিফা রাহ. এর মতে নামাযের মধ্যে দেখে দেখে কিরাত পড়লে নামায নষ্ট হয়ে যায়। পরিমাণে অল্প হোক বা বেশি, চাই একাকী নামাজ পড়ুক বা ইমাম হয়ে নামাজ পড়ুক। সর্বাবস্থায় কিরাত দেখে দেখে পড়লে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। (তাবয়ীনুল হাকায়েক, ১/১৫৮)
ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতের সাপেক্ষে দুটি কারণ উল্লেখ করেন।
وذهب أبو حنيفة إلى فساد الصلاة بالقراءة من المصحف مطلقا , قليلا كان أو كثيرا إماما أو منفردا أميا لا يمكنه القراءة إلا منه أو لا , وذكروا لأبي حنيفة في علة الفساد وجهين : أحدهما : أن حمل المصحفوالنظر فيه وتقليب الأوراق عمل كثير , والثاني أنه تلقن من المصحف فصار كما لو تلقن من غيره , وعلى الثاني لا فرق بين الموضوع والمحمول عنده , وعلى الأول يفترقان . واستثني من ذلك ما لو كان حافظا لما قرأه وقرأ بلا حمل فإنه لا تفسد صلاته ; لأن هذه القراءة مضافة إلى حفظه لا إلى تلقنه من المصحف ومجرد النظر بلا حمل غير مفسد لعدم وجهي الفساد . وقيل : لا تفسد ما لم يقرأ آية ; لأنه مقدار ما تجوز به الصلاة عنده . وذهب الصاحبان - أبو يوسف ومحمد - إلى كراهة القراءة من المصحف إن قصد التشبه باهل الكتاب (الموسوعة)
অর্থাৎ
(ক) কুর'আন শরীফ দেখে পড়ার জন্যে মাসহাফ হাতে ধরতে হয়, পৃষ্ঠা পরিবর্তন করতে হয়। যা আমলে কাছীর হওয়া স্পষ্ট আর আমলে কাছীর নামায ভঙ্গের কারণ।
(খ) নামাযের মধ্যে মাসহাফ দেখে পড়া অন্যের থেকে কুর'আন শরীফ শিখে নিয়ে পড়ার সাদৃশ্য। আর নামায অবস্থায় অন্যের থেকে শিখে তিলাওয়াত করাও নামায ভঙ্গের কারণ। ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে ফজল রহ. বলেন, যদি এমন হয় যে, কেউ মাসহাফ দেখে কুর'আন পড়তে পারে কিন্তু মুখস্ত পড়তে পারে না। এই ব্যক্তির জন্যে বিধান হল সে, কিরাত বিহীন নামায পড়বে। যদি নামাজে দেখে পড়ার অনুমতি থাকত তবে এমন ব্যক্তির জন্যে কিরাতবিহীন নামাজের অনুমতি দেওয়া হত না। ( আল মুহীতুল বুরহানী, ১/৩১১) আল বাহরুর রায়েক, ২/১১)
ইমাম আবূ হানীফা রাহ. এর মতের পক্ষে হাদীস ও আছারসমূহঃ
১। নামায অবস্থায় মাসহাফ ধারণ করে কিরাত পড়া রাসূলুল্লাহ সা. এর আদেশ থেকে দূরে সরে যাওয়া। কারণ রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা সেভাবেই নামায পড় যেভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখেছ। (বুখারী শরীফ হাঃ নঃ ৬০০৮)
নামায চলাকালীন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা. এর আমল সম্পর্কে সাইয়্যদুনা ওয়াইল ইবনে হুজর রা. বর্ণনা করেন, "অতঃপর তিনি নিজের ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখলেন। (মুসলিম শরীফ, হাঃ নঃ ৪০১)
এই বিধান বর্ণনা করার সময় সাহল ইবনে সাদ ইবনে মালেক রা. বলেন, "লোকদেরকে আদেশ দেওয়া হত যেন তারা নামাযে দাঁড়ানোর সময় ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখে। ( বুখারী শরীফ, হাঃ নঃ ৭৪০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হুকুম নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় স্পষ্ট। এখন যদি কেউ মোবাইলে বা মাসহাফে দেখে দেখে কিরাত পড়ে তাহলে লম্বা এক সময় তাকে একহাতে মাসহাফ বা মোবাইল ধারণ করে রাখতে হবে। যা রাসূলুল্লাহ সা. এর আদেশ ও আমলের বিপরীত। উপরোন্তু এটা আমলে কাছীর।
২। আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে নামাযে এদিক ওদিক তাকানোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এটা একটা বিঘ্নতা। এর দ্বারা শয়তান বান্দাদেরকে নামাযে বিঘ্নতা ঘটিয়ে থাকে। ( বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৭৫১ )
এ হাদীসে নামাযে এদিক ওদিক তাকানো থেকে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু নামাযে মাসহাফ বা মোবাইল দেখে দেখে কিরাত পড়ার কারণে দীর্ঘক্ষণ এদিক ওদিক তাকাতে হয়। যা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ।
৩। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, নামায অবস্থায় আমার নিকটে ঐ ব্যক্তিরা দাঁড়াবে যারা বুঝমান ও ইলমের অধিকারী। ( মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪৩২২)
যদি নামাযে কুর'আন মাজীদ দেখে পড়ার অনুমতি থাকত তবে এই হাদীসে কোন উদ্দেশ্য থাকে না। কেননা এই হাদীস উদ্দেশ্য হল, ইমামের কাছাকাছি যারা দাঁড়াবে তারা যেন কুর'আন জাননেওয়ালা হয়। যদি ইমাম কোন ভুল করে তাহলে যেন লোকমা দিতে পারে। এখন নামাযে যদি দেখে পড়ার অনুমতিই থাকে তবে এ হাদীসের কী মতলব?
৪। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম বলেন, "তোমরা আমার ও আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের নিয়মনীতিকে আবশ্যক করে নাও।" ( আবূ দাউদ, হাঃ নঃ ৪)
রাসূল সা. ও চার খলিফার স্বর্ণযুগে এমন কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরামের কেউ নামাযে মাসহাফ ধারণ করে দেখে দেখে তিলাওয়াত করেছেন। বরং অনেক সাহাবা থেকে নামাযে দেখে দেখে কিরাত পড়ার ব্যাপারে নিষেধ এর বর্ণনা পাওয়া যায়। যার বর্ণনা আসছে ইনশাআল্লাহ!
৫। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, " আমিরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব রা. আমদেরকে কুরআন দেখে দেখে ইমামতি করতে নিষেধ করেছেন এবং আরো নিষেধ করেছেন যেন, বালেগ না হয়ে ইমামতি না করে।" ( কিতাবুল মাসাহিফ- ১৮৯ পৃষ্ঠা )
৬। ইমাম ক্বাতাদা রাহ. সাঈদ ইবনুল মুসায়িব রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, যদি তাহাজ্জুদ নামাযে পড়ার জন্যে কারো স্মরণে সামান্যতম আয়াত মুখস্ত থাকে তবে তাই বারংবার পড়বে। তবুও নামাযে কুর'আন দেখে দেখে পড়বে না। ( প্রাগুক্ত)
৭। ইমাম লাইস রহ. হযরত মুজাহিদ রাহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি কুর'আন দেখে দেখে নামায পড়াকে মাকরুহ বলেছেন। কারণ এতে আহলে কিতাবের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। এরূপ আরও বর্ণনা পাওয়া যায় ইমাম ইবরাহীম রাহ. থেকে।
( বিস্তারিত দেখুন, কিতাবুল মাসাহিফ লিল ইমাম আবি দাউদ, ১৮৯, ১৯০, ১৯১ পৃষ্ঠা)
৮। খতীবে বাগদাদী রাহ. তার ইতিহাস গ্রন্থে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসার রাজি. এর আছার বর্ণনা করেন যে, তিনি এই বিষয়টা অপছন্দ করতেন যে, কোন ব্যক্তি রমজান মাসে তারাবীহ পড়াবে আর কুর'আন দেখে দেখে পড়বে। কেননা এটি আহলে কিতাবের আমল। দেখুনঃ তারীখে বাগদাদ ৯/১২০
৯। সাইয়েদুনা সুয়াইদ ইবনে হানজালা রাজি. এক গোত্রের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। যাদেরকে এক লোক কুর'আন শরীফ দেখে দেখে নামায পড়াচ্ছিলেন। এটা তিনি অপছন্দ করলেন এবং মাসহাফকে দূরে সরিয়ে দিলেন। এটা রমজান মাসের ঘটনা ছিল। ( মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, ২/১২৪, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, ২/৪১৯)
১০। আল্লামা ফুজায়েল ইবনে আয়াজ রাহ. বলেন, হাফেজে কুর'আনরা মূলত ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী।" (আত তিবইয়ান, ৫৫ পৃষ্ঠা)
একথার দ্বারা অনুমান করা যায় কুর'আন হিফজের মর্তবা কত বুলন্দ। যদি হিফজুল কুর'আন এর মধ্যে কমতি হতে থাকে তবে দ্বীনে গুরুত্বপূর্ণ কাজে কমতি পরিলক্ষিত হবে। যদি নামাযে দেখে দেখে কুর'আন পড়ার অনুমতি থাকে তবে রামযানে হাফেজগণ মুখস্থ পড়ার প্রতি উৎসাহিত থাকবে না। মানুষের মাঝে কুর'আন হিফজের ব্যাপারে অলসতা দেখা দিবে। এভাবে একসময় নাউযুবিল্লাহ মানুষের অন্তর থেকে কুর'আন মুছে যেতেও বেশি সময় লাগবে না
সারকথা..
উপরিউক্ত আলোচনায় বুঝা গেল, নামাযে মোবাইলে বা কুর'আন শরীফ ধারণ করত দেখে দেখে পড়ার অনুমতি নেই। এর পক্ষে কোন মারফু' হাদীসের দলীল নেই। উপরোন্তু এতে আমলে কাছীর হয় যা নামাযের বিপরীত বিষয়। আর মাসহাফ বা মোবাইল ধারণ না করে শুধুমাত্র দেখে দেখে নামাযে কিরাত পড়ার সম্পর্কেও কোন মারফু' হাদীস নেই। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের কিছু রিওয়ায়েত যা পাওয়া যায় সেগুলোর উপর আমল করা একাধিক মারফু' হাদীসের মুকাবেলায় পরিত্যাজ্য।
সবশেষে ইমাম ইবনে হাযম রাহ. এর একটি ফাতাওয়া উল্লেখ করে লেখা শেষ করছি।
ولا یحل لأحد أن یوٴم وهو ینظر ما یقرأ به في المصحف لا في فریضة ولا نافلة، فإن فعل عالما بأن ذلک لایجوز بطلت صلاته وصلاة من ائتم به عالما بحاله وعالما بأن ذلک لا یجوز" (المحلي- )
" কোন এরূপ ব্যক্তির পক্ষে ইমামতি করা জায়েয নেই যে নামাযে কুরআন মাজীদ দেখে দেখে কিরাত পড়ে। ফরজ নামাযেও নয়, নফল নামাযেও নয়। নাজায়িয জানা সত্বেও যদি কেউ এরূপ করে তবে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে এবং যারা তার পিছনে ইকতেদা করবে তাদের নামাযও নষ্ট হয়ে যাবে যদি মুক্তাদিরাও এ মাসয়ালা সম্পর্কে অবগত থাকে।" (দেখুনঃ আল মুহাল্লা, ৩য় খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা।
আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করুন।

কোন মন্তব্য নেই