কন্যাসন্তান; খোদায়ী শ্রেষ্ঠ দান
কন্যাসন্তান; খোদায়ী শ্রেষ্ঠ দান
পুত্র হোক কিংবা কন্যা- সন্তান হিসেবে উভয়ই মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি এক সুমহান অনুগ্রহ ও শ্রেষ্ঠ উপহার। ইসলাম কন্যা-পুত্র উভয়কেই আলাদা আলাদা সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে। তবে, তৎকালীন আরব সমাজ-বিশেষত ইসলামপূর্ব আরব সমাজের অন্ধ রেওয়াজ-রসম ও কুপ্রথা কন্যাসন্তানকে অত্যন্ত হীন নীচ ও অপমানকর বস্তু মনে করতো। কোনো পরিবারে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে সেই পরিবার তাকে আপদ মনে করতো। সমাজের লোকেরাও সেই পরিবারকে অশুভ পরিবার বলে আখ্যা দিতো। কন্যাসন্তান সম্পর্কে সে সময়ের আরো এমন উদ্ভট বিশ্বাস ও কার্যকলাপের কারণে ইসলাম কন্যাসন্তানের প্রতি আলাদা একটু গুরুত্ব দিয়েছে। সেই সমাজের অনেক বিশ্বাস ও কর্মকে ভ্রান্ত আখ্যা দিয়ে কন্যাসন্তানকে মহান আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ নেয়ামত ও উপহার বলে ঘোষণা দিয়েছে। একজন বাবার সৌভাগ্যের প্রতিক হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। বর্তমানে আমাদের সমাজেও এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যারা কন্যাসন্তানের জন্মকে ইতিবাচক চোখে দেখে না। কন্যাসন্তান জন্মদানের কারণে অনেকেই আবার তার মায়ের প্রতি অসন্তুষ্টি দেখান। বিভিন্ন পন্থায় নিজের ক্ষোভ যাহির করেন। অথচ এমন আচরণ সরাসরি সেই অন্ধযুগের কুপ্রথার সাথে সামঞ্জস্য প্রদান এবং আল্লাহর ফয়সালার প্রতি স্পষ্ট অসন্তুষ্টি প্রদর্শনেরই নামান্তর। কন্যাসন্তান সম্পর্কে সেই অন্ধযুগের মানুষের হীন বিশ্বাসের চিত্র আল্লাহ তায়ালা কোরআনে তুলে ধরেছেন। এরশাদ করেছেন, ‘যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার চেহারা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং অসয্য মনস্তাপে সে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। (এবং চিন্তা করে), হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। শুনে রাখো, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট’। (সূরা নাহল : ৫৮-৫৯)। একারণেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যাসন্তানকে খুব বেশি ভালোবাসতেন। জীবনভর তিনি কন্যাদেরকে স্নেহ করেছেন। কন্যাসন্তান প্রতিপালনে অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন ও উৎসাহ দিয়েছেন। এক হাদিসে রাসূল বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার দুই কন্যাকে সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে এ দু’টি আঙ্গুলের মতো পাশাপাশি থাকবো। (এরপর তিনি তাঁর আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে দেখালেন’)। (মুসলিম, তিরমিযি)। অন্য এক হাদিসে রাসূল বলেন, ‘যার ঘরে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে, আর সে ওই কন্যাকে কষ্ট না দেয়, তার ওপর অসন্তুষ্টও না হয় এবং তার ওপর কোনো পুত্র সন্তানকে প্রাধান্য না দেয় তবে সেই কন্যার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’। (আহমাদ)। অপর এক হাদিসে রাসূল এরশাদ করেন, ‘ওই নারী বরকতময়ী ও সৌভাগ্যবতী যার প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। কেননা, (সন্তানদানের নেয়ামত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে) আল্লাহ তায়ালা কন্যার কথা আগে উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন’। (কানযুল উম্মাল)। উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, ‘আমার কাছে এক মহিলা এলো। তার সঙ্গে ছিলো তার দুই মেয়ে। আমার কাছে সে কিছু প্রার্থনা করলো। সে আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না। আমি তাকে সেটি দিয়ে দিলাম। সে তা নিলো এবং দুই টুকরো করে তার দুই মেয়ের মাঝে ভাগ করে দিলো। সে নিজে কিছুই খেলো না। তারপর মহিলাটি ও তার দুই মেয়ে উঠে চলে গেলো। এরমধ্যেই আমার কাছে রাসূল আসলেন। আমি তাঁর কাছে ওই মহিলার কাহিনী বললাম। রাসূল তখন বললেন, যাকে কন্যাসন্তান দান করে কোনো বিষয়ে পরীক্ষা করা হয় আর সে তাদের প্রতি যথাযথ আচরণ করে, তবে সেই সন্তান তার জন্য আগুন থেকে রক্ষাকারী হবে। (মুসলিম, আহমাদ)। অপর এক হাদিসে এসেছে, রাসূল এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান রয়েছে, আর সে তাদের ওপর বিয়ে দেয়া অথবা মৃত্যু পর্যন্ত অর্থ খরচ করতে থাকে তবে তারা তার জন্য আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। তখন এক নারী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কারো যদি দুই মেয়ে হয় তবে? রাসূল বললেন, দুই মেয়ে হলে তবুও। (বায়হাকি)। এই কন্যার প্রতিপালনে কেবল পিতাকেই নয়, বরং ভাইকেও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কারণ, হাদিসে কন্যার সাথে সাথে বোনের লালন-পালনের ব্যাপারেও সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, কারো যদি তিনটি কন্যা বা বোন থাকে অথবা দু’টি কন্যা বা বোন থাকে আর সে তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে, তবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আহমাদ)। মোটকথা, হাদিসে পাকে এ ব্যাপারে আরো নানাবিধ প্রাপ্তি পুরষ্কার ও সুসংবাদের ঘোষণা এসেছে। সুতরাং যারা কন্যাসন্তানকে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ দান ও উপহার ভেবে তাদের সাথে সদাচারণ করবে, তাদের সাবালেকা ও পরবর্তীতে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত তাদের যাবতীয় প্রয়োজন হাশিমুখে ও আনন্দচিত্তে পূরণ করবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ইহকাল ও পরকালে অভাবনীয় পুরষ্কারে পুরষ্কৃত করবেন। বিপরীতে যারা তাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করবে, তাদের লালন-পালন ও প্রয়োজন পূরণে অবহেলা করবে, তাদের ওপর খরচ করাকে অর্থদন্ড মনে করবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তাঁর ওয়াদাকৃত সকল পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করবেন।এবং পরকালে কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন করবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে আমাদের কন্যাসন্তানদের প্রতি পূর্ণ স্নেহশীল বানিয়ে তাঁর ঘোষিত সকল পুরষ্কার অর্জনের তাউফিক দান করুন।।লেখক
হাফেজ মাওলানা মুফতি রায়হান ফেরদৌস
সহকারী মুফতি ও মুহাদ্দিস
আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া ইদারাতুল উলূম ঢাকা
আফতাবনগর মসজিদ মাদরাসা কমপ্লেক্স।
মেরুল বাড্ডা ঢাকা ১২১২

কোন মন্তব্য নেই