রোযার ‘ফিদয়া’ সংক্রান্ত জরুরি মাসায়েল
রোযার ‘ফিদয়া’ সংক্রান্ত জরুরি মাসায়েল
অনেক সময় অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার কারণে অনেকে রমযান মাসে রোযা রাখতে পারেন না। তাদের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শরীয়তে রোযার পরিবর্তে ফিদয়া দেয়ার অনুমতি রয়েছে। উক্ত ফিদয়া কখন, কাকে, কিভাবে ও কী পরিমাণ দিতে হবে? তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এ বিষয়ে আবার অনেক ভুল ধারণাও সমাজে প্রচলিত আছে। তাই আমাদের ফিদয়া সংক্রান্ত মৌলিক বিধানগুলো জেনে নেয়া দরকার। উল্লেখিত বিষয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। আশা করি, আলোচনাটি সংশ্লিষ্ট সকলের উপকারে আসবে।
অনেক সময় অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার কারণে অনেকে রমযান মাসে রোযা রাখতে পারেন না। তাদের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শরীয়তে রোযার পরিবর্তে ফিদয়া দেয়ার অনুমতি রয়েছে। উক্ত ফিদয়া কখন, কাকে, কিভাবে ও কী পরিমাণ দিতে হবে? তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এ বিষয়ে আবার অনেক ভুল ধারণাও সমাজে প্রচলিত আছে। তাই আমাদের ফিদয়া সংক্রান্ত মৌলিক বিধানগুলো জেনে নেয়া দরকার। উল্লেখিত বিষয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। আশা করি, আলোচনাটি সংশ্লিষ্ট সকলের উপকারে আসবে।
‘ফিদয়া’ কী?
‘ফিদয়া’ শব্দটি মূলত আরবী الفدية থেকে। এর শাব্দিক অর্থ, মুক্তিপণ। শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কোনো আবশ্যিক বিধান পালন করা ছুটে গেলে এর মুক্তিপণ হিসেবে ধার্যকৃত একটি আর্থিক অনুদান। দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য অর্থ বা খাবার প্রদানের মাধ্যমে উক্ত অনুদান আদায় করা হয়। এ শব্দটি সরাসরি কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে।
‘ফিদয়া’ কেন দিতে হয়?
প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমানের ওপর রমযান মাসের রোযা রাখা ফরয। এটি আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত ফরয বিধান। কিন্তু যারা বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা কিংবা অসুস্থতার কারণে রোযা রাখতে অপারগ তাদের করণীয় কী? তাদের ফরয রোযা পালনের দায় থেকে মুক্তির উপায় কী? ইসলামী শরীয়ত তাদের দায়মুক্তির উপায় হিসেবেই ‘ফিদয়া’ আদায়ের বিধান দিয়েছে।
‘ফিদয়া’ কারা দিতে পারবেন?
রোযার পরিবর্তে ফিদয়া কেবল নিম্নোক্ত দু’ধরনের লোকই আদায় করতে পারবেন। এছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি ফিদয়া দিতে পারবেন না। দিলেও তা আদায় হবে না; বরং তাদেরকে নিয়মমতো রোযা রাখতে হবে বা পরবর্তীতে কাযা করতে হবে। যথা:
১. অতিশয় দুর্বল বৃদ্ধলোক, যার রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতেও কাযা করতে পারবেন বলে কোনো সম্ভাবনা নেই এমন ব্যক্তি রোযার পরিবর্তে ফিদয়া প্রদান করবেন।
১. অতিশয় দুর্বল বৃদ্ধলোক, যার রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতেও কাযা করতে পারবেন বলে কোনো সম্ভাবনা নেই এমন ব্যক্তি রোযার পরিবর্তে ফিদয়া প্রদান করবেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ
‘আর যাদের জন্য রোযা রাখা কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদয়া- একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করা।’
[সূরা বাকারা : ১৮৪; আলমুহীতুল
বুরহানী ৩/৩৬১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া
১/২০৭]
[সূরা বাকারা : ১৮৪; আলমুহীতুল
বুরহানী ৩/৩৬১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া
১/২০৭]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, উল্লেখিত আয়াতের বিধান রহিত হয়নি। এটি রোযা রাখতে অক্ষম বৃদ্ধের জন্য প্রযোজ্য। সে রোযার পরিবর্তে মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করবে।
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস:
৭৫৭৩]
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস:
৭৫৭৩]
তাবেয়ী ছাবেত আল-বুনানী রাহ. বলেন-
ﻛﺒﺮ ﺃﻧﺲ ﺑﻦ ﻣﺎﻟﻚ ﺣﺘﻰ ﻛﺎﻥ ﻻ ﻳﻄﻴﻖ اﻟﺼﻴﺎﻡ، ﻓﻜﺎﻥ ﻳﻔﻄﺮ ﻭﻳﻄﻌﻢ
‘আনাস ইবনে মালেক রাযি. বার্ধক্যের কারণে যখন রোযা রাখতে অক্ষম হয়ে পড়েন তখন তিনি রোযা না রেখে (দরিদ্রকে) খাবার খাওয়াতেন।’
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস:
৭৫৭০]
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস:
৭৫৭০]
২. রোযা রাখতে অক্ষম এমন গুরুতর রোগী, যার ভবিষ্যতে সুস্থ হওয়ার কিংবা পরবর্তীতে রোযা কাযা করতে পারবেন বলে কোনো সম্ভাবনা নেই এমন ব্যক্তিও রোযার পরিবর্তে ফিদয়া আদায় করতে পারবেন।
ইকরিমা রাহ. বলেন, আমার মা প্রচন্ড তৃষ্ণা-রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রমযান মাসে রোযা রাখতে সক্ষম ছিলেন না। তাঁর সম্পর্কে আমি তাউস রাহ.কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে এক ‘মুদ’ (প্রায় পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম প্রদান করবে।
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৫৮১]
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৫৮১]
সাধারণ অসুস্থতায় ফিদয়া নয় :
কোনো ব্যক্তি যদি অসুস্থতার কারণে অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তারের পরামর্শে রোযা রাখা থেকে বিরত থাকেন এবং পরবর্তীতে তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে সুস্থ হওয়ার পর তাকে রোযার কাযা আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে তার ফিদয়া দেয়া যথেষ্ট হবে না। কেননা রোযার পরিবর্তে ফিদয়া দেয়ার সুযোগ কেবল এমন মারাত্মক রোগীর জন্যই প্রযোজ্য, যার আরোগ্য লাভ করার এবং রোযা রাখার শক্তি ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সাময়িক ওজরে রোযা না রাখলে ফিদয়া নয় :
উপরোল্লিখিত দুই শ্রেণির মানুষ (অর্থাৎ দুর্বল বৃদ্ধ ও সুস্থতার সম্ভাবনাহীন জটিল রোগী) ছাড়া আরো যাদের জন্য সাময়িকভাবে রোযা না রাখা বৈধ (যেমন মুসাফির, গর্ভবতী ও শিশুকে স্তন্যদানকারিনী) তারা ওজরের কারণে রমযানে রোযা না রাখলে রোযার পরিবর্তে ফিদয়া দিতে পারবেন না; বরং তাদেরকে পরবর্তীতে রোযার কাযা আদায় করতে হবে।
তবে কেউ উক্ত ওজর অবস্থায়ই মারা গেলে তার ওপর রোযার কাযা ও ফিদয়া কোনোটিই ওয়াজিব হবে না। অবশ্য ওজর শেষ হওয়ার পর (অর্থাৎ মুসাফির মুকীম হওয়ার পর, গর্ভবতী নারীর সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া ও স্রাব বন্ধ হওয়ার পর এবং স্তন্যদানকারিনী স্তন্যদান বন্ধ করার পর) মৃত্যুবরণ করলে ওজর শেষে যে ক’দিন রোযা রাখার সময় ও সুযোগ পেয়েছে সে ক’দিনের কাযা যিম্মায় আসবে। কাযা না করলে উক্ত দিনগুলির ফিদয়া প্রদানের অসিয়ত করে যেতে হবে।
[মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস: ৭৬৩০,৭৬৩৫; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৩; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৫৫]
[মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস: ৭৬৩০,৭৬৩৫; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৩; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৫৫]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন-
ﺗﻔﻄﺮ اﻟﺤﺎﻣﻞ ﻭاﻟﻤﺮﺿﻊ ﻓﻲ ﺭﻣﻀﺎﻥ، ﻭﺗﻘﻀﻴﺎﻥ ﺻﻴﺎﻣﺎ ﻭﻻ ﺗﻄﻌﻤﺎﻥ
‘গর্ভবতী ও শিশুকে স্তন্য দানকারিনী নারীর জন্য রমযানে রোযা না রাখার অবকাশ রয়েছে। তারা পরবর্তীতে রোযাগুলো কাযা করে নিবে। রোযার বদলে খাদ্য দান করবে না।’
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস: ৭০৬৪]
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস: ৭০৬৪]
রোযা কাযা করার সামর্থ্য না থাকলে:
বার্ধক্য বা গুরুতর অসুস্থতার কারণে যদি কেউ সম্পূর্ণরূপে রোযা রাখার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন তবে তিনি জীবদ্দশায় তার ফিদয়া আদায় করে দিবেন। যদি জীবদ্দশায় ফিদয়া আদায় না করেন তাহলে তার জন্য মৃত্যুর পূর্বে ফিদয়া আদায়ের অসিয়ত করে যাওয়া জরুরি। অসিয়ত করে গেলে তার পরিত্যক্ত সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে তার ফিদয়া আদায় করা হবে। কিন্তু যদি উক্ত ব্যক্তি অসিয়ত না করে থাকেন তবে তার ওয়ারিশদের সম্মতি ব্যতীত মিরাসের ইজমালী সম্পদ থেকে ফিদয়া আদায় করা যাবে না। অবশ্য ওয়ারিশদের সকলে যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে মৃতের ফিদয়া আদায় করে দেয় তবে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা তা কবুল করবেন এবং তাকে মাফ করে দিবেন।
উল্লেখ্য যে, ওয়ারিশদের মধ্যে কোনো নাবালেগ থাকলে তার অনুমতি সাপেক্ষেও তার প্রাপ্য সম্পদ থেকে মৃতের ফিদয়া আদায় করা যাবে না। সেক্ষেত্রে ফিদয়া দিতে চাইলে প্রাপ্তবয়স্ক ওয়ারিশগণ নিজেদের প্রাপ্য অংশ থেকেই শুধু দিতে পারবেন।
[আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৪-৪২৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭]
[আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৪-৪২৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭]
ফিদয়া আদায়ের জন্য ধনী হওয়া জরুরি নয়:
ফিদয়া আদায় আবশ্যক হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া জরুরি নয়। বার্ধক্য বা জটিল কোনো রোগের কারণে যাদের রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতে কাযা করার সামর্থ্য ফিরে পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই তাদের সবার উপর সমানহারে ফিদয়া আদায় করা আবশ্যক।
ফিদয়া আদায়ের সামর্থ্য না থাকলে:
রোযা রাখতে অক্ষম বৃদ্ধ ও গুরুতর রোগী দরিদ্রতার দরুন ফিদয়া দিতে একেবারেই অক্ষম হলে আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করবেন। নিজের অক্ষমতা ও অসমর্থতার জন্য ক্ষমা চাইবেন। আর পরবর্তীতে কখনো সামর্থ্যবান হলে অবশ্যই ফিদয়া আদায় করে দিবেন।
[ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৫৯]
[ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৫৯]
ফিদয়া দেয়ার পর রোযার সামর্থ্য হলে:
অক্ষম বৃদ্ধ ও মৃত্যুমুখে পতিত রোগী যদি রোযার পরিবর্তে ফিদয়া দেয়ার পর সুস্থতা ফিরে পান এবং আবার রোযা রাখার সক্ষমতা লাভ করেন তাহলে তাকে ছুটে যাওয়া রোযাগুলোর কাযা আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে তার পূর্বে আদায়কৃত ফিদয়া সাধারণ দান হিসেবে গণ্য হবে। এর জন্য তিনি আলাদা সওয়াব পাবেন।
[আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭]
[আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭]
ফিদয়ার পরিমাণ:
এক রোযার পরিবর্তে একটি ফিদয়া আবশ্যক হয়। আর এক ফিদয়া হলো, একজন দরিদ্র লোককে তৃপ্তি সহকারে দু’বেলা খাবার খাওয়ানো অথবা এর মূল্য প্রদান করা। অবশ্য কেউ যদি প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে সদকাতুল ফিতরের সমপরিমাণ অর্থাৎ এক সা’ (আধুনিক পরিমাপে ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম) জব, খেজুর, পনির ও কিসমিস বা এগুলোর কোনোটির মূল্য গরিবকে দান করে অথবা আধা সা’ (১ কেজি ৬৩৫ গ্রাম) গম বা তার মূল্য দান করে তবে তাও আদায় হয়ে যাবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন-
اﻟﺸﻴﺦ اﻟﻜﺒﻴﺮ اﻟﺬﻱ ﻻ ﻳﺴﺘﻄﻴﻊ اﻟﺼﻴﺎﻡ ﻓﻴﻔﻄﺮ، ﻭﻳﻄﻌﻢ ﻋﻦ ﻛﻞ ﻳﻮﻡ ﻣﺴﻜﻴﻨﺎ ﻧﺼﻒ ﺻﺎﻉ ﻣﻦ ﺣﻨﻄﺔ
‘অতিশয় বৃদ্ধলোক যে রোযা রাখতে সক্ষম নয়, সে প্রতিদিনের রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে আধা সা’ গম প্রদান করবে।’
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস:
৭৫৭৪; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৬]
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস:
৭৫৭৪; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৬]
অতীতের অনাদায়ী ফিদয়া কোন সময়ের মূল্যে দিবে?
যদি কোনো মাজুর ব্যক্তির অতীতের ছুটে যাওয়া রোযার ফিদয়া অনাদায়ী থাকে তাহলে তিনি যখন ফিদয়া দিবেন তখনকার খাদ্যদ্রব্যের বাজারদর হিসেবে ফিদয়া আদায় করবেন। অবশ্য সরাসরি খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিদয়া আদায় করলে নির্ধারিত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য দিলেই ফিদয়া আদায় হয়ে যাবে।
[আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৪১]
[আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৪১]
ফিদয়ায় খাবার বা তার মূল্য দেয়াই কি জরুরি?
বার্ধক্য বা জটিল রোগের কারণে যার বর্তমানে রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং ভবিষ্যতেও সামর্থ্য লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই তার জন্য রোযার পরিবর্তে দরিদ্রকে খাবার খাওয়ানো বা তার মূল্য দেওয়াই জরুরি নয়; বরং তিনি ফিদয়ার সমমূল্যে অন্য জিনিসও দিতে পারবেন। যেমন, পরিধেয় বস্ত্র বা দরিদ্র লোকের প্রয়োজনীয় অন্য কোনো বস্তু দেয়া যাবে।
[কিফায়াতুল মুফতী ৬/৩৮৭; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৪৯]
[কিফায়াতুল মুফতী ৬/৩৮৭; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৪৯]
ফিদয়া কখন আদায় করবেন?
যাদের জন্য রোযার পরিবর্তে ফিদয়া দেওয়ার অনুমতি রয়েছে তারা চাইলে
রমযানের শুরুতেই পুরা রমযানের ফিদয়া একত্রে আদায় করে দিতে পারবেন। আবার চাইলে রমযানের শেষেও আদায় করতে পারবেন। আর রমযানের ভিতরে আদায় করতে না পারলে পরেও আদায় করা যাবে। তবে যত দ্রুত সম্ভব তা আদায় করে দেওয়া ভালো।
[আলবাহরুর রায়েক ২/২৮৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭; হাশিয়া তাহতাবী আলালমারাকী পৃ. ৩৭৬; হাশিয়া তাহতাবী আলাদ্দুর ১/৪৬৫; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; ফাতাওয়া উসমানী ২/১৯২]
রমযানের শুরুতেই পুরা রমযানের ফিদয়া একত্রে আদায় করে দিতে পারবেন। আবার চাইলে রমযানের শেষেও আদায় করতে পারবেন। আর রমযানের ভিতরে আদায় করতে না পারলে পরেও আদায় করা যাবে। তবে যত দ্রুত সম্ভব তা আদায় করে দেওয়া ভালো।
[আলবাহরুর রায়েক ২/২৮৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭; হাশিয়া তাহতাবী আলালমারাকী পৃ. ৩৭৬; হাশিয়া তাহতাবী আলাদ্দুর ১/৪৬৫; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; ফাতাওয়া উসমানী ২/১৯২]
রমযানের আগেই ফিদয়া দেওয়া:
রমযান মাস শুরু হওয়ার আগে ফিদয়া দেওয়া সহীহ নয়। দিলেও তা আদায় হবে না; বরং সাধারণ দান হিসেবে গণ্য হবে। তাই উক্ত ফিদয়া পুনরায় আদায় করতে হবে।
[আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৪৬]
[আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৪৬]
ফিদয়া কাদেরকে দেওয়া যাবে?
ফিদয়ার হকদার ঐসকল গরিব লোক, যারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত। যেসব দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাকাতের উপযুক্ত ছাত্র-ছাত্রী আছে, সেখানেও ফিদয়া দেওয়া যাবে।
[সূরা বাকারা: ১৮৪; আল ইনায়াহ ২/২৭৩; ফাতাওয়া উসমানী ২/১৯১]
[সূরা বাকারা: ১৮৪; আল ইনায়াহ ২/২৭৩; ফাতাওয়া উসমানী ২/১৯১]
বিধর্মীকে ফিদয়া দেওয়া:
নামায ও রোযার ফিদয়া কেবল দরিদ্র মুসলমানকেই দিতে হবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে ফিদয়া দেওয়া জায়েয নয়। দিলেও তা আদায় হবে না; বরং উক্ত ফিদয়া পুনরায় আদায় করতে হবে। তবে সাধারণ দান-খায়রাত অমুসলিমকেও করা যাবে।
[আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৪২]
[আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৪২]
নাবালেগকে ফিদয়া দেওয়া:
ছোট বাচ্চা বা নাবালেগকে ফিদয়া বাবদ খাবার খাওয়ালে ফিদয়া আদায় হবে না। তবে তাকে খাবারের মূল্য দিলে ফিদয়া আদায় হয়ে যাবে। আর এক্ষেত্রে নাবালেগের পিতা দরিদ্র হতে হবে। নাবালেগের পিতা ধনী তথা নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে উক্ত নাবালেগকে ফিদয়া দেওয়া যাবে না।
[ফাতাওয়া খানিয়া ২/২০; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৬০]
[ফাতাওয়া খানিয়া ২/২০; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৬০]
পিতা-মাতা ও সন্তানকে ফিদয়া দেওয়া:
পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যারা ফিদয়া-দাতার জন্মের উৎস তাদেরকে তার নিজের রোযার ফিদয়া দেওয়া জায়েয নয়। এমনিভাবে নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতিন এবং তাদের অধস্তনকে নিজের অনাদায়ী রোযার ফিদয়া দেওয়া বৈধ নয়। তদ্রূপ স্বামী এবং স্ত্রী একে অপরকে নিজেদের ফিদয়া দিতে পারবেন না। এদের ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন যদি যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয় তাহলে তাদেরকে ফিদয়া দেওয়া যাবে; বরং অন্যদের তুলনায় তাদেরকে দেওয়াই উত্তম। যেমন, ভাই-বোন, ভাতিজা, ভাগনে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা এদেরকে ফিদয়া দেওয়া যাবে।
[ফাতাওয়া রহীমিয়া ৭/২৭২]
[ফাতাওয়া রহীমিয়া ৭/২৭২]
ফিদয়ার অর্থ মসজিদ-মাদরাসার নির্মাণকাজে ব্যয় করা:
ফিদয়ার অর্থ দ্বারা মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদি জায়েয নয়। তদ্রূপ কোনো জনকল্যাণমূলক কাজেও ফিদয়ার অর্থ ব্যয় করা বৈধ নয়। এমনটি করা হলে ফিদয়া আদায় হবে না। যেমন রাস্তা-ঘাট, পুল নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুৎ-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ফিদয়ার টাকা এর হক্বদারকেই দিতে হবে। হক্বদারদের না দিয়ে অন্য কোনো ভালো খাতে ব্যয় করলেও ফিদয়া আদায় হবে না।
[ফাতাওয়া মাহমূদিয়া ১০/১৭৮]
[ফাতাওয়া মাহমূদিয়া ১০/১৭৮]
ফিদয়ার অর্থ পারিশ্রমিকস্বরূপ দেওয়া:
বাড়ির কাজের ছেলে বা মেয়েকে ফিদয়া দেওয়া জায়েয যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়। তবে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে ফিদয়ার অর্থ দিলে ফিদয়া আদায় হবে না। কেউ কেউ কাজের লোক রাখার সময় বলে, মাসে এত টাকা করে পাবে আর ঈদে একটা বড় অংক পাবে। এক্ষেত্রে ঈদের সময় দেওয়া টাকা ফিদয়ার অর্থ থেকে প্রদান করা যাবে না। সেটা তার পারিশ্রমিকের অংশ বলেই ধর্তব্য হবে।
ফিদয়া কতজনকে দিতে হবে?
এক রোযার ফিদয়া একজন মিসকিনকে দেওয়াই উত্তম। তবে একাধিক ব্যক্তিকে দিলেও ফিদয়া আদায় হয়ে যাবে। তদ্রূপ একাধিক রোযার ফিদয়া একজন মিসকিনকে দেওয়া জায়েয।
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস:
৭৫৭৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪২৪; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ পৃ. ৬৮৮; ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১২৪; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৩১; ফাতাওয়া রহীমিয়া ৭/২৭১; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া ১০/১৯১; মাআরিফুল কুরআন ১/৪৪৬]
[মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস:
৭৫৭৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪২৪; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ পৃ. ৬৮৮; ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১২৪; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৩১; ফাতাওয়া রহীমিয়া ৭/২৭১; ফাতাওয়া মাহমূদিয়া ১০/১৯১; মাআরিফুল কুরআন ১/৪৪৬]
অক্ষম বা মৃত ব্যক্তির পক্ষে অন্যের রোযা রাখা:
রোযা রাখতে অক্ষম ব্যক্তির পক্ষ থেকে অন্য কেউ রোযা রাখা কিংবা মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার অনাদায়ী রোযাগুলো অন্য কারো রাখার বিধান নেই। তাই তাদের অনাদায়ী রোযাগুলো পরিবারের সদস্যরা বা অন্য কেউ রাখলেও তাদের পক্ষ থেকে তা আদায় হবে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
ﻻ ﻳﺼﻠﻴﻦ أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ، ﻭلاَ يَصُوﻣﻦ أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ، ﻭﻟﻜﻦ ﺇﻥ ﻛﻨﺖ ﻓﺎﻋﻼ ﺗﺼﺪﻗﺖ ﻋﻨﻪ ﺃﻭ ﺃﻫﺪﻳﺖ
‘কেউ অন্যের পক্ষ থেকে নামায আদায় করবে না এবং অন্যের পক্ষ থেকে রোযা রাখবে না। তবে তুমি যদি এমন কিছু করতেই চাও তাহলে মৃতের পক্ষে সদকা করো বা হাদিয়া দাও।’
[মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস: ১৬৩৪৬; মুআত্তা ইমাম মালেক, পৃষ্ঠা ৯৪]
[মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস: ১৬৩৪৬; মুআত্তা ইমাম মালেক, পৃষ্ঠা ৯৪]
সুতরাং অক্ষম ও মৃত ব্যক্তির অনাদায়ী রোযার জন্য ফিদয়া আদায় করবে। প্রতিটি রোযার জন্য কোনো দরিদ্র লোককে দু’বেলা পরিমিত খাবার বা তার মূল্য দান করবে। অবশ্য ঈসালে সওয়াবের (সওয়াব পৌঁছানোর) জন্য নফল রোযা রাখার অবকাশ আছে।
আর মৃত ব্যক্তি যদি মৃত্যুকালে ফিদয়া দেওয়ার অসিয়ত করে থাকে তবে তার রেখে যাওয়া সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে অসিয়ত পূর্ণ করা জরুরি হবে। অসিয়ত না করে থাকলে তার পক্ষে ফিদয়া দেওয়া জরুরি নয়। তবে বালেগ ওয়ারিশগণ উত্তরাধিকার সম্পদে নিজেদের প্রাপ্যাংশ থেকে ফিদয়া আদায় করলে তা আদায় হবে বলে আশা করা যায়।
[ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৪; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৫৩, ২/২৬৩; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬০; ইলাউস সুনান ৯/১৫৯; শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/৪৪২]
[ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৪; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৫৩, ২/২৬৩; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬০; ইলাউস সুনান ৯/১৫৯; শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/৪৪২]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর যাবতীয় হুকুম যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন।

কোন মন্তব্য নেই