মেয়েদের মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে সামাজিক ট্যাবু ভাঙার মিশনে নেমেছেন কিছু মানুশ
মেয়েদের মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে সামাজিক ট্যাবু ভাঙার মিশনে নেমেছেন কিছু মানুশ। পিরিয়ড বিষয়ক খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানিয়ে তারা অনলাইন ক্যাম্পেইন করেছেন। এদের মধ্যে আমার ক্লাসমেট, জুনিয়র ভাই-বোনেরা আছেন। আমি যদি তাদের আহ্বান ও বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একাত্ম হতে পারতাম, সেটা আমার জন্য খুবই আনন্দের বিষয় হতো।
সুবহানাল্লাহ, কী চমৎকার ভাষাশৈলী! আল্লাহ প্রশ্নের সমাধান শুধু দিচ্ছেন না, উত্তর প্রদানের আগে প্রশ্নকারীর কথাও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করছেন।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়ে মাসিক, সহবাস, নেফাস তথা প্রসব পরবর্তী রক্তপাত, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতাসহ নারীঘনিষ্ঠ সকল বিধিবিধান নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের সামনে বিশদভাবে অসঙ্কোচে বিবৃত করেছেন। নারী সাহাবিরা অসঙ্কোচে যেকোনো প্রশ্ন করেছেন, রাসূল সমাধান বাতলে দিয়েছেন।
তবে, সাহাবিরা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে লজ্জার প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন এটা ঠিক, কিন্তু তাই বলে এসব বিষয়ে তাদের স্বাভাবিক লজ্জাবোধকে বিসর্জন দেন নি।
ফলে মাসিক বা পিরিয়ড মুসলিম সমাজে ট্যাবু নয়, অন্তত হওয়া তো উচিত নয়ই। অধম নিজে মসজিদে দাঁড়িয়ে পিরিয়ড ইত্যাদি বিষয়ক প্রয়োজনীয় আলোচনা নানা সময়েই করি। একারণে আমি কখনও বাধাপ্রাপ্ত হই নি, বরং সবাই বিষয়টিকে স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় হিসেবেই দেখেছে বলে আমার মনে হয়েছে। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে, তবু বলি— দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর পঞ্চম শ্রেণিতেই পিরিয়ড, বয়ঃসন্ধিকালীন ও যৌনতাবিষয়ক প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করা হয়। এটা কেবল এই আধুনিক সময়ের কথা নয়, শতশত বছর ধরে মাদরাসা শিক্ষায় এগুলো সিলেবাসভুক্ত আছে।
সুতরাং পিরিয়ড নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা, জ্ঞানার্জন বা গণসচেতনতা তৈরি— কোনোটাই সমস্যাজনক নয়। সমস্যা তৈরি হয় তখন, এর আড়ালে যখন ভিন্নতর কোনো উদ্দেশ্যের শঙ্কা ও সংশয় তৈরি হয়।
পিরিয়ডের ট্যাবু ভাঙতে গিয়ে তারা নারী-পুরুষের স্বাভাবিক লজ্জাবোধকে এনকার করা শুরু করেছেন। তাদের কাছে লজ্জাটাই মূলত ট্যাবু, তাই লজ্জার দেয়ালটা ভেঙে ফেলতে হবে। তাদের কথা— যা স্বাভাবিক, যা অনিবার্য তা নিয়ে কোনো লাজলজ্জা থাকা যাবে না ; প্রকাশ্যে অসঙ্কোচে তা নিয়ে কথা বলতে হবে। পিরিয়ড লজ্জার কোনো বিষয় নয়, এটি প্রকাশ্য আলোচনায় উঠে আসতে হবে সবার সঙ্গে, সবখানে।
ফ্যালাসিটা এখানেই। যা স্বাভাবিক তা নিয়ে লজ্জাবোধ থাকা ঠিক নয় একথা মেনে নিলে সমাজে লাজলজ্জা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। নাদিয়ারা রক্তমাখা প্যাডের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে এই যুক্তিতেই। ফেমিনিস্টরা নেংটা হয়ে চলাফেরার অধিকার দাবি করে এই একই কুযুক্তিতে।
পৃথিবীতে আরও অনেক কিছুই স্বাভাবিক। নারী পুরুষের সঙ্গম-সহবাস স্বাভাবিক ও অনিবার্য ; তা বলে আপনি রাস্তাঘাটে সেটা করতে পারেন না। মলত্যাগ, বায়ূত্যাগ স্বাভাবিক বলে জনসম্মুখে সেটা করতে পারেন না, এর অপ্রয়োজনীয় আলোচনাও অনভিপ্রেত। এসবের আলোচনা প্রয়োজন হলেও, স্বাভাবিক লজ্জা রুচিবোধকে বিসর্জন দিয়ে আপনি তা করেন না। আপনার সন্তানকে, আপনার শিক্ষার্থীকে এগুলো আপনি শেখাবেন এটা তো ঠিক আছে, কিন্তু একই সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক লজ্জা ও রুচিবোধ শেখানোও জরুরি।
আমরা এটাই বলি যে, পিরিয়ড বিষয়ে কোনো রকম অজ্ঞতা নিশ্চয়ই কাম্য নয়, আপনার সন্তানকে বা এর শিক্ষাটা যার দরকার তাকে নিশ্চয়ই আপনি শেখাবেন ; তবে স্বাভাবিক লজ্জাবোধকে বিসর্জন দেয়ার যে সবক আপনারা দিচ্ছেন সেটা অবশ্যই বর্জনীয়।
আপনি জানেন আপনার অস্তিত্বে মা-বাবার মিলন অনিবার্য এক সত্য, কিন্তু এই সত্যিটা বলে বেড়ানোয় কোনো গৌরব নেই, আছে লজ্জা। আপনার বোনের, আপনার মায়ের ঋতুস্রাবের খবর আপনি জানতেই পারেন কোনোভাবে, কিন্তু আপনার বন্ধু বান্ধবের এর রটনা অশোভনই নয় শুধু, চূড়ান্ত পর্যায়ের নোংরামি।
লক্ষ করুন, নারীর বিশেষ স্থান থেকে রক্তক্ষরণকে আপনারাও মাসিক বা পিরিয়ড বলে ব্যক্ত করছেন। এর মধ্যে যে লজ্জার বোধটা আছে সেটা কি টের পাচ্ছেন? আপনি সরাসরি রক্তক্ষরণ বলতে সঙ্কোচবোধ করছেন তাই এর শালীন নাম রেখেছেন মাসিক বা পিরিয়ড। সহবাস, পায়খানা ইত্যাদির বুৎপত্তিগত অর্থ তো ভিন্ন, কিন্তু শালীনতা বজায় রাখার জরুরতে আপনি শব্দগুলিকে বিশেষ কাজের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। লজ্জা, শালীনতা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটা সমাজের ভূষণ। একে বিলুপ্ত নয়, রক্ষা করুন।
©কপিকৃত
কোন মন্তব্য নেই